যেকোনো কাজ করার আগে বা কোনো কিছু কেনার আগে আমরা দেখি আমাদের কাছে কত টাকা আছে আর কিনতে গেলে কত টাকা লাগবে। এটা কিন্তু এক ধরণের বাজেট। আবার মাসে কত টাকা আয় করছি, আর  কত ব্যয় হচ্ছে সেটার হিসাব রাখা দৈনন্দিন জীবনের বাজেট। যারা বাজেট করে চলে না তাদের মাস শেষে ধার করতে হয়। বছর শেষে পাওনাদারদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। 

এটা যদি দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে হয় তাহলে ব্যবসার ক্ষেত্রে বাজেট করা তাহলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা নিশ্চয়ই আর বুঝতে বাকি নেই।

ব্যবসা শুরু করার আগেই বেশ অনেকগুলো কাজ করতে হয়, এর মধ্যে ব্যবসায়ের বাজেট করাটাও অন্যতম। CBinsights এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ছোট ব্যবসা গুলো ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অন্যতম কিছু কারণ হলো – দাম এবং খরচে অসামঞ্জস্যতা, লক্ষ্য স্থির না থাকা এবং বাজেট শেষ হয়ে যাওয়া! ব্যবসার এই সমস্যা গুলো পরিকল্পিত ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বাজেট প্রস্ততের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে  পারে। 

বাজেট করার পূর্বেই, আপনার ব্যবসার লক্ষ্য ঠিক করে নিতে হবে। সে অনুযায়ী আপনি বাজেট তৈরি করবেন। 

SMART– পদ্ধতি অনুসরণ করে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য বলতে বোঝায় এমন গন্তব্য যার ফলাফল খুব শিঘ্রই দেখা যাবে। যেমন – অপারেশনাল খরচ কমানোর জন্য বেশি ভাড়ার অফিসের বদলে কম ভাড়ার অফিস নেয়া, প্রডাকশন বাড়ানোর জন্য কর্মী নিয়োগ দেয়া।

দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য বলতে এমন গন্তব্য যার ফলাফল খুব শিঘ্রই দেখা যাবে না কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতে কোনো গুরুত্বপূর্ন লক্ষ্য অর্জন করাকে বোঝায়। যেমন ব্যবসাকে ডিজিটালাইজ করা যার ফলে বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি একসাথে দেখা যাবে এবং সহজেই ব্যবসার বিভিন্ন তথ্যের বিশ্লেষণ করা যাবে।

ব্যবসার বাজেট করার ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই প্র‍্যাকটিকাল হতে হবে, এক্ষেত্রে আপনার ব্যবসার ধরণ, আর্থিক সক্ষমতাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। আপনি কত টাকা খরচ করবেন সেটা ব্যবসার সামগ্রিক অপারেশনের উপর নির্ভরশীল। লক্ষ্য ঠিক করা হয়ে গেলে নীচের ধাপগুলোর মাধ্যমে আপনি আপনার ব্যবসার বাজেট তৈরী করতে পারবেন।

আমরা উদাহরণ হিসেবে একটি ছোট মার্কেটিং এজেন্সি স্টার্টাপের জন্য একটি বাজেট এর উদাহরণ উপস্থাপন করলাম। আপনারা এই ফাইলটা Copy as a new file হিসেবে কপি করে আপনার ব্যবসার জন্য বাজেট বানাতে পারেন। 

১. খরচ বিশ্লেষণ করা –  

ব্যবসার বাজেট করার পূর্বেই গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার ব্যবসা পরিচালনার সকল খরচ খুঁজে বের করা।

আপনি যদি না বুঝে এবং সকল বিষয় না জেনেই বাজেট করেন তাহলে পরবর্তীতে যখন ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন হবে তখন তা ব্যবসাকে ঝুঁকিতে ফেলে দেবে।

বাজেটে খরচগুলো মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়। 

১/ ফিক্সড কস্ট, 

২/ ওভারহেড কস্ট

৩/ ওয়ান টাইম / স্টার্টাপ কস্ট

ফিক্সড কস্ট হল সেই খরচ যা প্রতি মাসেই আপনাকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যয় করতে হয়। বিজনেসের লাভ লোকসান যাই হোক, সে পরিমাণ খরচ আপনার হবেই।

যেমন, একটি ছোট মার্কেটিং এজেন্সি স্টার্টাপের জন্য ফিক্সড কস্ট হতে পারে – 

অফিস ভাড়া মাসিক ২০,০০০/- টাকা, 

কর্মীদের স্যালারি দিতে হয় ১৬৭,০০০/- টাকা,  

অফিসের ইউটিলিটি ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দিতে হয় ১০.০০০/- টাকা।

তাহলে আমাদের মাসিক ফিক্সড কস্ট হচ্ছে – মোট ২৪৫,০০০/- টাকা।









ওভার হেড কস্ট সরাসরি উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত নয় কিন্ত ব্যবসার দৈনন্দিন কার্যাবলি পরিচালনায় সহায়ক এমন কিছু খরচ।

যেমন –  এখানে আমাদের খরচগুলো হল – ইন্টারনেট বিল যায় মাসিক ৩,০০০/- টাকা, মোবাইল বিল যায় ১,০০০/- টাকা, অফিস খরচ ১০,০০০/- টাকা এবং ইউটিলিটি বিল যায় ৪,৫০০/- টাকা। 

তাহলে আমাদের মাসিক ওভারহেড কস্ট হচ্ছে – মোট ২৪৫,০০০/- টাকা।


ওয়ান টাইম / স্টার্টাপ কস্ট হল কিছু এককালীন খরচ যেগুলো স্টার্টাপ প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক কালে করা হয়ে থাকে।

এখানে আমাদের খরচগুলো হল – অফিস ডেস্ক তৈরীতে ১,০০০০০/- টাকা, লাইট ফ্যান কিনতে ১৮,৫০০/- টাকা, ট্রেড লাইসেন্স করতে খরচ হয়েছে  ১২,৫০০/- টাকা, প্রিন্টার কিনতে, ৯০০০/- টাকা, কম্পিউটার কিনতে ৫,০০০০০/- টাকা, চেয়ার কিনতে ৬০,০০০/- টাকা, ডোমেইন হোস্টিং রেজিস্ট্রেশনে ৫,০০০/- টাকা, ডিজিটাল ক্যামেরা কিনতে ৩,০০০০০/- টাকা

তাহলে আমাদের স্টার্টাপ কস্ট হচ্ছে- মোট ১০০৪৫০০/- টাকা।

২. আয় অনুমান করুন –  

ব্যবসা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো অতিরিক্ত আয় অনুমান করা এবং হিসাব না রাখা। আয় থেকে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে অতিরিক্ত ঋণ করা হয় এবং সে অনুযায়ী আয় না হওয়ার কারণে ব্যবসার প্রফিট নেগেটিভে চলে আসে। এজন্য, ব্যবসা শুরুর পর মাসিক, ত্রৈমাসিক এবং বাৎসরিক আয় হিসাব করা উচিত। 

ছোট মার্কেটিং এজেন্সির জন্য আমরা দুইটি জায়গা থেকে আয় করবো। একটি হচ্ছে রিটেইনার বেইস ক্লায়েন্ট অর্থাৎ ফিক্সড ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্ট – ১ থেকে আয় হয় ২৫,০০০/- টাকা, ক্লায়েন্ট ২ থেকে আসে ১৫,০০০ টাকা এবং ক্লায়েন্ট – ৩ থেকে আসে ৩০,০০০/- হাজার টাকা, ক্লায়েন্ট – ৪ থেকে আসে ৩৫০০০/- টাকা এবং ক্লায়তেন্ট ৫ থেকে আয় হয় ৪৫,০০০/- টাকা।  ফেইসবুক বুস্টিং (মিডিয়া বায়িং) থেকে আসবে ৫০,০০০/- টাকা।

মোট আসবে ২০০,০০০/- টাকা



এছাড়া প্রজেক্ট বেসিসে মাসিক ৩ টা প্রজেক্ট কমপ্লিট করলে আসবে মোট আসবে ৭৫,০০০/-  টাকা।

৩. প্রান্তিক মুনাফা সম্পর্কে জানা –  

মোট প্রান্তিক মুনাফা বলতে বছরের শেষে ব্যবসার সমস্ত খরচ মেটানোর পরে আপনার ব্যালেন্সে থাকা নগদ অর্থকে বোঝায়। এটি আপনার ব্যবসার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে সাহায্য করে।
মাসিক আয় হচ্ছে – ২৭৫,০০০/- টাকা এবং খরচ ২৬৩,৫০০/- টাকা


বছরান্তে, এন্ডিং ব্যালেন্স ২০৪০,৮০০/-  টাকা। অর্থাৎ ব্যবসাটি লাভজনক অবস্থায় আছে।

যখন আপনি আপনার ইনকামিং ক্যাশ ফ্লো সম্পর্কে অবগত হবেন তখন কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ হিসাব করাটাও সহজ হবে। এছাড়াও আপনার ফিক্সড সরবরাহকারী/ভেন্ডরদের বিল পরিশোধ করাটাও সহজ হবে। 

চলমান থাকে এবং সে সময় আপনি অন্য কিছু কাস্টমারকে টার্গেট করে ব্যবসা করতে পারবেন। এর মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন ব্যবসা রান করার জন্য কেমন মুনাফা দরকার, কি পরিমাণ অর্থ ব্যবসার পিক সিজনে সেইভ করলে নন-সিজনে ব্যবসা চলমান রাখা যাবে।



৪. খরচের সীমা নির্ধারণ করুন – 

বাজেট করার অর্থ হচ্ছে আপনার খরচ গুলো একত্রিত করা এবং সেগুলো আয় থেকে বাদ দেওয়া। কতটা বিজ্ঞতার সাথে আপনি খরচ করেন তা নির্ধারণ করবে আপনার ব্যবসা কত ভালো চলবে। লক্ষ্য স্থির করার মাধ্যমে আপনার বুঝতে সুবিধা হবে যে আপনি কি সঠিক খাতে টাকা খরচ করছেন নাকি অন্য খাতে? এতে করে অনাকাঙ্খিত খরচ হওয়া থেকে বিরত থাকা যাবে। 

উদাহরনস্বরূপ, আপনি যদি এমন কোনো স্টেশনারি আইটেমে টাকা খরচ করেন যেটা ব্যবসার কোনো লাভ এনে দিচ্ছে না তাহলে এই খরচকে বাদ দিয়ে সে টাকা আপনার ব্যবসার মার্কেটিং এর কাজে লাগানো প্রয়োজন। এতে করে আপনার ব্যবসার প্রচার ও প্রসার হবে। 

৫. সবকিছু একত্রিত করুন –

পূর্বের সব গুলো ধাপ অতিক্রমের পর এবার আপনার কাজ হলো সব গুলো তথ্য ধাপ অনুসারে একত্রিত করা। এবার বাজেট করার পালা। সকল খরচ আয় থেকে বাদ দেওয়ার পর কত টাকা নিয়ে আপনার কাজ করতে হবে সেটার একটা ধারণা পাবেন। অনাকাঙ্খিত যেকোনো খরচ ফেইস করার জন্য অবশ্যই নিজেকে প্রস্তুত রাখুন। এবার আপনি আপনার স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলোতে  পৌছানোর জন্য সঠিক স্থানে অর্থ ব্যয় করুন।

একাউন্টিং সফটওয়্যার এর ভূমিকা – 

ব্যবসায় বাজেট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ, যার জন্য আপনার অন্য কারো সাহায্য দরকার হতে পারে। একাউন্টিং সফটওয়্যার ব্যবহার করলে ব্যবসার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্যগুলো গুছিয়ে উপস্থাপন করে। এটা দিয়ে  বাজেটও তৈরী করা যায়। 

তবে আপনার ব্যবসা ছোট থাকলে গুগল শিট কিংবা মাইক্রোসফট এক্সেলের মাধ্যমে আমাদের দেওয়া উদাহরণ ব্যবহার করে আপনি কোনো বাড়তি খরচ ছাড়াই কাজ চালানোর মতো একটি বাজেট করতে পারেন। 

সর্বশেষে, বাজেটিং ব্যবসার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ; বিশেষ করে ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। কারণ বাজেট করার মাধ্যমে তারা অর্থের হিসাব রাখতে পারবে এবং কোথায় কত টাকা কিভাবে খরচ হচ্ছে তা জানা যায়। বাজেট করার মাধ্যমে ব্যবসায়িক লক্ষ্যে পৌঁছাতে কেমন অর্থ প্রয়োজন এবং বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত সমস্যা সমাধানের সময় যাতে হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকে তা নিশ্চিত করে। ছোট ব্যাসায়ীদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ১ বছরের বাজেট করা কঠিন ব্যাপার, সেক্ষেত্রে ২/৩ মাসের বাজেট করা ব্যবসার জন্য ফলপ্রসূ।