বাংলাদেশে একজন উদ্যোক্তা যেসব জিনিস সবচেয়ে বেশি ভয় পান, তার মধ্যে একটি হলো ব্যাবসাশুরুর আইন-কানুন। অথচ ব্যাবসা শুরুর আইন-কানুন এমন জটিল কোনো বিষয় নয়। আসলে অজানা সব কিছুই ভীতিকর। ব্যবসায়িক আইন আসলে এমন কিছু নিয়ম নীতি যা ব্যবসার বৈধতা স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক অনেক সুবিধা নিশ্চিত করে।

ব্যাবসা আইন কেন গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশে একজন উদ্যোক্তা যেসব জিনিস সবচেয়ে বেশি ভয় পান, তার মধ্যে একটি হলো ব্যাবসা শুরুর আইন-কানুন। অথচ ব্যাবসা শুরুর আইন-কানুন এমন জটিল কোনো বিষয় নয়। আসলে অজানা সব কিছুই ভীতিকর। ব্যবসায়িক আইন আসলে এমন কিছু নিয়ম নীতি যা ব্যবসার বৈধতা স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক অনেক সুবিধা নিশ্চিত করে।  

ব্যাবসা আইন কেন গুরুত্বপূর্ণ

অন্যান্য সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারেরও একটা বড় দায়িত্ব জনগণের অধিকার সংরক্ষণ করা। ব্যাবসায়িক আইনগুলো এ কারণেই করা হয় যেন উদ্যোক্তা এবং ভোক্তা সবারই স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। ধরুন, আপনি একটি খাদ্য  পণ্য উৎপাদন করলেন, কিন্তু পণ্যের গায়ে উৎপাদনের তারিখ বা মেয়াদের তারিখ কিছুই লেখা নেই। হয়তো আপনি ভাবলেন এই পণ্য তো খাওয়া হয়ে যাবে। কিন্তু যিনি কিনলেন তিনি খাবারটা খাননি। বেশ কিছুদিন পরে তিনি খাবারটা দেখলেন এবং পরিবারসহ খেলেন। ইতিমধ্যে খাবারটার ভেতরে বেশ কিছু অণুজীব জন্ম নিয়েছে, বেড়ে উঠেছে। এটা খেয়ে তিনি তার পরিবারসহ হাসপাতালে গেলেন। অথচ যদি প্যাকেজে উৎপাদন এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার তারিখ দেওয়া থাকত – এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটত না। 

এই অনভিপ্রেত ঘটনাগুলো ঠেকানোর জন্যই নিরাপদ খাদ্য আইন এর মতো আইন করা। এ ছাড়াও বাংলাদেশে বহু অসাধু ব্যবসায়ী আছে যারা মানুষকে ঠকিয়ে বড়লোক হতে চায়। এদের হাত থেকে ক্রেতাদের রক্ষা করার জন্য আছে ভোক্তা অধিকার আইন। 

একজন নবীন উদ্যোক্তার জন্য ট্রেড লাইসেন্স করা জরুরী কারণ ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্ট  খোলা সম্ভব হয় না।

 

ব্যাবসা শুরুতে কোন আইন

নতুন কোনো ব্যবসার শুরুতে আসলে খুব বেশি কিছু লাগে না। একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই মূলত ব্যবসার অফিশিয়াল যাত্রা শুরু হয়। ব্যবসার একাধিক উদ্যোক্তা থাকলে উদ্যোক্তাদের নিজেদের মধ্যে একটি বিস্তারিত চুক্তি – কে কতটুকু মূলধন দিল, কে কত অংশের মালিক এবং কীভাবে ব্যাবসা পরিচালিত হবে এই বিষয়গুলো বিস্তারিত লিখে নন – জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে তা প্রিন্ট স্বাক্ষর করে উভয় পক্ষের কাছে রেখে দেওয়া উচিত। ট্রেড লাইসেন্স অনেক সময় একজন মালিকের নামে হয়, একাধিক মালিক থাকলে সবার নামেই লাইসেন্স থাকা বাঞ্ছনীয়। ট্রেড লাইসেন্স করা খুবই সহজ কাজ।   

ট্রেড লাইসেন্স কি, কীভাবে করতে হয়?

যেকোনো ধরনের ব্যাবসা শুরু করার জন্য যে লাইসেন্স গ্রহন না করলে বৈধভাবে ব্যবসাই শুরু করা যাবেনা, সেটা হল ট্রেড লাইসেন্স (Trade Licence) বা বানিজ্য অনুমোদন পত্র। ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করার জন্য প্রধান কোনো কার্যালয় নেই। তবে স্থানীয় সরকারের, স্থানীয় পর্যায়ের সকল অফিস যেমন পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এর মধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পাঁচটি এবং দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের পাঁচটি অঞ্চল নিজ নিজ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করে থাকে।

ব্যবসার ধরন ও মালিকানার ধরনের উপর নির্ভর করে ট্রেড লাইসেন্সর ফি নির্ধারিত হয়। সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া যদি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন করা হয় তাহলে ব্যাবসা শুরুর সময় পেইড আপ ক্যাপিটাল এর উপর নির্ভর করে ট্রেড লাইসেন্স ফি নির্ধারিত হয়ে থাকে। সাধারণত, একটি লাইসেন্স পেতে তিন থেকে সাত কর্ম দিবস সময় লাগতে পারে।

 

যেকোনো নাগরিক ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার জন্য সর্বনিম্ন বয়স হল ১৮ বছর। 

১/ নতুন ট্রেড লাইসেন্স

২/ ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন

ব্যবসাভেদে বাংলাদেশে মোট ২৯৪টি ক্যাটাগরির ভিন্ন ভিন্ন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়। আপনার ব্যবসাটা কোন ধরণের সেটা দেখে নিতে পারেন এই লিঙ্ক থেকে। 

নতুন ট্রেড লাইসেন্সের জন্য যেসকল কাগজপত্র লাগে তা হলো –

১/ পুরণকৃত ট্রেড লাইসেন্স আবেদন ফর্ম

২/ নির্দিষ্ট ভাড়ার চুক্তিতে দোকান/অফিস ব্যবহার করলে ৩০০ টাকার নন – জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প কাগজে লেখা দোকান/অফিস ভাড়ার চুক্তি পত্রের ফটোকপি  

৩/ নিজস্ব জায়গায় দোকান/অফিস হলে ইউটিলিটি বিল ও হালনাগাদকৃত হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ করার ফটোকপি ।

৪/ আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।

৫/ আবেদনকারীর ৩ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।

৬/ দুই বা ততোধিক ব্যক্তির যৌথভাবে পরিচালিত ব্যবসার ক্ষেত্রে মালিকগণ ৩০০ টাকার সরকার নির্ধারিত  নন – জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প কাগজে ব্যাবসা যৌথভাবে পরিচালনা করার সম্পাদিত চুক্তি।
৭/ নির্ধারিত আবেদন ফি ব্যাংক জমা রশিদ

ট্রেড লাইসেন্স করার প্রক্রিয়া

ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ করতে হয়:

১/  নির্ধারিত আবেদন ফর্ম পূরণ করুন

আপনার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান শহরে সিটি কর্পোরেশনের অধীনে হলে সিটি কর্পোরেশন, নগরভবনের নীচতলা  বা তাদের আঞ্চলিক অফিস থেকে ফর্মটি কিনতে হবে। আর সিটি কর্পোরেশনের বাইরে হলে পৌরসভা, ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদ অফিস থেকে ফর্ম সংগ্রহ করতে হবে।

আপনার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানটি কোথায় পড়েছে তা জানতে ভিজিট করুন – 

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল বিভাগ – লোকেশন এবং আয়তন
 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল বিভাগ – লোকেশন এবং আয়তন। 

এছাড়াও চাইলে অনলাইনে ফর্মটি ডাউনলোড করেও প্রিন্ট করে নেয়া যাবে।

২/ উপরে উল্লেখিত সবগুলো কাগজপত্র প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা অথবা ওয়ার্ড কাউন্সিলর দ্বারা সত্যায়িত করে আবেদন ফর্মের সাথে যুক্ত করতে হবে। 

৩/ ব্যাংক ফি ছাড়া বাকি সব কাগজসহ আবেদন ফর্মটি পূরণ করে স্থানীয় সরকার অফিসে জমা দিতে হবে। ফর্ম জমা নেওয়ার পর আবেদনপত্রের তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হয়। এই কাজে আবেদনপত্র পাওয়ার পর লাইসেন্সিং সুপারভাইজার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় সরেজমিনে পরিদর্শনে যান।

৪/ পরিদর্শনের পরে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হবে। এরপর ওই অফিস থেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কর বিষয়ক কর্মকর্তা ট্রেড লাইসেন্স দেবেন।

৫/ ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ অর্থ বছরের সাথে সম্পর্কিত। প্রতি বছর জুলাই মাসে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। যেমন, মে মাসে ট্রেড লাইসেন্স করলে তা মাত্র দুই মাস পরেই আবার জুলাই মাসে নবায়ন করতে হবে। পুরোনো ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ফি নতুন ট্রেড লাইসেন্স এর থেকে বেশি। কারণ ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করার সময় উৎস কর দিতে হয়।

যেকোনো ধরনের সরকারি বা অন্যান্য বিভাগের কাগজ পত্র অনুমোদন বা ইস্যু করার ক্ষেত্রে ভোগান্তি বা হয়রানি এড়াতে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা অফিসের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করুন। সংগৃহীত অনুমোদিত সকল আইনী কাগজ-পত্র যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করুন।
ট্রেড লাইসেন্স সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন ট্রেড লাইসেন্সের আদ্যোপান্ত বইটি।

ট্রেড লাইসেন্সের পরে কী?

১/ স্থানীয় বাজারের জন্য কোনো পণ্য উৎপাদন করলে অবশ্যই ট্রেডমার্ক গ্রহণ করতে হবে। ট্রেডমার্ক নিবন্ধন আপনার পণ্যকে অন্য সকল অসৎ ব্যবসায়ীর থেকে হেফাজতে সাহায্য করবে। এটা আপনার পণ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বত্মকে রক্ষা করবে। আপনার ব্র্যান্ডের লেবেল, লোগো, মোড়ক কেমন হবে তা এর মাধ্যমে নিবিন্ধিত হবে। পাশাপাশি আপনার অনুরুপ লোগো বা রঙ ব্যবহার করে কেউ আপনার নকল করলে সে একজন অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। 

২/ বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধ পণ্য সম্পর্কে জানতে হবে। যেমন- রেডবুল এনার্জি ড্রিংক বাংলাদেশে বিক্রয় করতে পারবেন না। কারণ এটা নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃক নিষিদ্ধ। আপনার বৈধ কোন বিদেশি চকলেট বা খাদ্য পণ্যও আমদানিকারকের সিল ছাড়া বিক্রি করতে পারবেন না।

৩/ আপনার ব্যাবসা যদি আমদানি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট হয় তাহলে আপনাকে আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট অনুমোদন ও এলসি প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি এই সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন জানতে হবে। 

৪/ একটা কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে প্রতিটা ধাপেই আইনগত বিষয়াদি আসে। এক্ষেত্রে অবশ্যই দালালদের পরিহার করে একজন ভাল আইনজীবি নির্বাচন করতে হবে যিনি আপনাকে এসকল কাজে সহায়তা করবেন। অন্যথায় আপনার আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা যেতে পারে। 

৫/  আপনাকে স্থানীয় বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে লিয়াজো করে চলতে হবে। 

পরিশেষে ব্যবসার আইনি দিক সচেতনতার ব্যাপার, ভয় পাবার নয়। ব্যাবসা বড় হওয়ার সাথে সাথে আপনি জানতে পারবেন আপনার এর পরবর্তীতে কি কি আইনগত ভিত্তি দরকার। বিয়াহ কিংবা এসএমই ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যবসায়ীদের আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও আপনার উদ্যোগের পূর্বসূরীদের মেন্টর হিসেবে গ্রহণ করলে তারা অনেক সুপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারবে।

আইন কি ব্যাবসার মুনাফা প্রভাবিত করে?

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে হয়ত সব ধরনের আইন সবসময় মুনাফা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে না। কিন্তু বড় পরিসরের ব্যাবসা বা কোম্পানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আইন বা লাইসেন্স প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুনাফা বৃদ্ধিতে প্রভাব রাখে। 

সবসময় অধিক পরিমানে পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমেই অধিক মুনাফা অর্জিত হয়না, বরং অনাকাঙ্খিত খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ী মাধ্যমেও অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। 

ব্যবসায়ের মূল চালিকা শক্তি কোম্পানির কর্মী বা শ্রমিকগণ দিনের পর দিন নিজেদের মেধা, শ্রম, সময় দিয়ে কোম্পানিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের উৎসাহ, উদ্দীপনা, সৃজনশীলতা, কর্মতৎপরতা, উৎপাদনশীলতা, আত্মত্যাগ এবং পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উপরই রচিত হয় মুনাফার ভিত্তি প্রস্তর। কিন্তু এসব গুণাবলীর সমন্বয়কারী হল ডিসেন্ট ওয়ার্ক যা অনেকগুলো শ্রম আইনের সমষ্টি। ডিসেন্ট ওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একজন কর্মী তার ন্যায্য অধিকার পাওয়ার মাধ্যমে কাজে প্রশান্তি এবং নিরাপত্তা খুঁজে পায় ফলে স্বাভাবিকভাবেই কর্মীগণের আত্মত্যাগ (Dedication) বেড়ে যায়।